মানিক হোসেন, রাজশাহী প্রতিনিধি: আমায় দে রে দে ছাড়িয়া… বন্দী হইয়া মনোয়া পাখি হায়রে কান্দে রইয়া রইয়া… এই গান যদি বাঁশিতে শোনা যায় মন উচাটন বা ছটফট করবেনা এমন মানুষ খুব কম।
বড় জায়গায় সুযোগ পাবেন বাঁশির জোরে এমন ইচ্ছে যেন মরীচিকা হয়ে দাঁড়িয়েছে বাঁশিওয়ালার জীবনে। বংশীবাদক গণেশ দা। এই বাঁশিওয়ালাকে এক নামে চেনেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মামারা। সকাল হলেই পুরোনো দিনের কালজয়ী গানের সুরে বাঁশি বাজিয়ে হাটে-বাজারে, মাঠে-ঘাটে, পথে-প্রান্তরে বিচরণ করেন তিনি। পুঠিয়া, নওহাটা, কাঁকন হাট, রাজশাহী শহর, নাটোর বনপাড়া সহ বিভিন্ন জায়গায় দেখে মেলে তাঁর। বাঁশি বাজানোর সুবাদে নবাব সিরাজউদ্দৌলা, রাজা হরিশ্চন্দ্র, রুপবান, রাখাল বন্ধুসহ বিভিন্ন যাত্রাপালায় বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন। পুরোনো মেলা, যাত্রাপালা, গান, বাঁশি, ঢাক, ঢোল, তবলা কিছুই আগের মত নেই। হারিয়ে যাচ্ছে বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন তিনি।
জানা গেছে, তিনি ৬৫ বছর জীবনে ৪৫ বছরই বাঁশি বাজানো, তৈরি ও বিক্রির পেছনে সময় ব্যয় করেছেন। ঠিক ৪৫ বছর আগে কাঁচা কলা কিনে বাজারে বিক্রি করতেন। আর এটাই ছিল প্রথম পেশা। সেই সময় পুঠিয়ার রায়ের মেলায় বাঁশি বাজিয়ে কলা বিক্রি করছিলেন। এমন সময় কাশেম মোল্লা নামের এক বাঁশিওয়ালা এসে ২ টাকা দরে ৩০০ টি বাঁশি ধরিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, কলার ব্যবসা করা লাগবে না। বাঁশি বানিয়ে, ঘুরে ঘুরে বাঁজিয়ে মানুষের মাঝে বিক্রি করলেই ভালো আয় সম্ভব। সেই বাঁশিগুলো তাহেরপুর হাটে গিয়ে, হকারের অনুরোধে মাইকে বাজালেন। আশ্চর্য্য হয়েছিলেন শ্রী গণেশ চন্দ্র দাস। নিমিষেই বাঁশিগুলো ২০ টাকা পিস বিক্রি হয়ে গিয়েছিল। ৬০০ টাকায় কিনে ৬ হাজার টাকায় বিক্রি দেখে পেশা হিসেবে বেছে নিলেন বাঁশির ব্যবসা। ৪০ বছর আগে খুব ভালো করে বাঁশি বানানো শেখেন ওস্তাদ খলিলের কাছে। ৩৮ বছর আগে গুরু শ্রী কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মাচারীর কাছে বাঁশি বাঁজানো শেখেন।
তাঁর পরিবার সম্পর্কে জানতে চাইলে জানান, তিনি পুঠিয়া দুদুরমোড়ের বাসিন্দা। বাবা শ্রী নিতাই চন্দ্র দাস যিনি ২৫ বছর আগে গত হয়েছেন। মা ৯৬ বছর বয়সী বৃদ্ধা শ্রীমতি সবিতা রানী দাস। টিনের চালের টিনের ঘরেই বসবাস। তারা ছিলেন ৫ ভাইবোনের মধ্যে ২য় । তাঁর স্ত্রী শ্রীমান রিনা বালা রানী ব্লাড ক্যান্সারে ১৩ বছর আগে গত হয়েছেন। তাঁর সন্তানদের মধ্যে দুই ছেলে রাজমিস্ত্রী ও বারোভাঁজার দোকান নিয়ে ব্যবসার কাজ করেন। বিয়ে করে আলাদা করে খায়। তিনি আর তাঁর মা ছাড়া ।
ব্যবসা সম্পর্কে জানান, ছয় মাস সময় নিয়ে তিনি বাঁশি বানান। প্রতিবছরের শুরুতে তিনি ১ লাখ টাকার বাঁশ কেনেন। বাঁশগুলো পানিতে রাখা, কাঁদা লাগানো, রোদে শুকানো, পরিমাণ মত কাটা, ছিদ্র করা, সিরিজ কাগজ দিয়ে মসৃন করা, সরিষার ফুলের রং দেয়া, মেশিনে দেয়া, কয়লায় পুড়িয়ে নকশা করাসহ বিভিন্ন পর্যায়ের মাধ্যমে বাঁশি তৈরির কাজ শেষ করেন তিনি। বাঁশিগুলোতে বাড়তি গোপন ২ টি ছিদ্রসহ ১১ টি ছিদ্র থাকে। তাঁর তৈরি বাঁশিগুলো ৫০ থেকে ৬ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। অনেক সময় হেঁটে হেঁটে খুচরা বিক্রির সাথে সাথে পাইকারি বিক্রি করেন। আনুমানিক ১ লাখ টাকায় ৫ লক্ষ টাকা আয় হয়। ৬ হাজার টাকার বাঁশি বছরে ৬ টা বিক্রি হয়।
রাজশাহী বিশ্ব বিদ্যালয়ের ফলিত রসায়ন বিভাগের শিক্ষার্থী সেলিম আল বাচ্চু বলেন, ক্যাম্পাসে তিনি আসেন। মানুষের মনে সুর বাঁজিয়ে বাঁশি বিক্রি করেন। রেডিও পদ্মায় তিনি সাক্ষাৎকারে গিয়েছিলেন। তাঁর ইচ্ছা অপূর্ণ থেকে গেল, যদি ভালো জায়গায় বাঁশি বাজানোর সুযোগ পেতেন ভালো হতো।
দৈনিক কলম কথা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।